সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :: আজ ৬ ডিসেম্বর “দীন দুনিয়ার মালিক খোদা এত কষ্ঠ সয়না তোমার দিল্কি দয়া হয়না’ “চাইনা দুনিয়ার জমিদারী কঠিন বন্ধুরে”, “নৌকা আগে আগে চলেরে ঐ নৌকাটা শেখ মুজিবের”, “সাজিয়ে গুজিয়ে দে”,“কাঙ্কের কলসী জলে গিয়াছে ভাসি” ও ‘প্রেমের মরা জলে ডুবেনা’ সহ প্রায় ৬ হাজার গানের রচয়িতা গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশার (কামাল উদ্দিন) ১২২ তম জন্মবার্ষিকী। ১৯০১ সালের এই দিনে তদানীন্তন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার দিরাই থানার ভাটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন এই মরমী সাধক। মৃত্যুবরন করেন ১৯৮৫ সালের ৩রা মে।
এ উপলক্ষ্যে ৬ ডিসেম্বর বুধবার দিনভর সুনামগঞ্জ জেলা সহ ঢাকা-সিলেট ও দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে পৃথক পৃথক আলোচনা সভা ও কামালগীতি পরিবেশনের আয়োজন করা হয়েছে। কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ সুনামগঞ্জ এর প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের মরমী সংস্কৃতির উজ্জল নক্ষত্র ও সুনামগঞ্জের পঞ্চরতœ বাউলের মধ্যমণি বাউল কামাল পাশা,শুধু গান রচনাই নয় ঐতিহাসিক নানকার আন্দোলন,৪৭ এর গণভোট আন্দোলন,৫২ এর ভাষা আন্দোলন,৫৪‘র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন,৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচন ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদান রাখেন। ৭০ এর পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচন উপলক্ষে হাওরাঞ্চলে গণ সংযোগে আগত আওয়ামীলীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভামঞ্চে নৌকার পক্ষে গণসঙ্গীত পরিবেশন এবং ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট ও সেলা সাবসেক্টরের বিভিন্ন মুক্তিফৌজ ক্যাম্পে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধাদের উৎসাহিত করে জাগরনী গান পরিবেশনের পাশাপাশি এই শিল্পী স্বাধীকার স্বাধীনতা ও স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে নিরলস শ্রম সাধনা অব্যাহত রাখেন। বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদের সংগ্রহে এই প্রয়াত লোককবির প্রায় দেড় হাজারের বেশী গান রয়েছে।
জানা যায়,গত ২৫ অক্টোবর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব বরাবরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী কর্তৃক বাউল কামাল পাশা কে শিল্পকলা (সংগীত) ক্ষেত্রে মরণোত্তর একুশে পদক ২০২৪ মনোনয়নের জন্য প্রস্তাব প্রেরণ করেন। এর আগে ২০২০-২০১৮ইং সনে সাবেক জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ,২০১৭ইং সালে সাবিরুল ইসলাম, ২০১৪ইং সনে শেখ রফিকুল ইসলাম এবং ২০১৩-২০১১ইং সালে মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী,বাউল কামাল পাশা (কামাল উদ্দিন) কে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করার জন্য পর পর ৯বার প্রস্তাবনা প্রেরণ করলেও এখন পর্যন্ত এই শিল্পীর ভাগ্যে জোটেনি মরণোত্তর স্বীকৃতি।
২০২০ইং সনে চিকিৎস্যাবিদ্যায় স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত অধ্যাপক ডাঃ উবায়দুল কবীর চৌধুরী বলেন,জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সর্বপ্রথম গণসংগীত রচয়িতা হচ্ছেন ভাটি বাংলার বিখ্যাত বাউল শিল্পী কামাল পাশা। যিনি ৫২ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারি দিরাই থানার রাজানগর কেপিসি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ঢাকায় ছঅত্র হত্যার প্রতিবাদে,“শেখ মুজিব কারাগারে আন্দোলন কেউ নাহি ছাড়ে,সত্যাগ্রহে এক কাতারে সামনে আছেন সামাদ ভাই ঢাকার বুকে গুলি কেন ? নুরুল আমিন জবাব চাই” শীর্ষক ভাষা আন্দোলন উপলক্ষ্যে একটি ঐতিহাসিক দেশাত্ববোধক গানে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর নামটি স্বগর্বে স্বমহীমায় সর্বপ্রথম উচ্চারন করেছিলেন।
হুইল চেয়ারে চলাচলকারী দেশের সর্বশেষ বেঁচে থাকা ৩ জনের অন্যতম যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম সামছুল ইসলাম বলেন,৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে “তোমরা অস্ত্র ধরোরে বীর বাঙ্গালী ভাই পাঞ্জাবী আসিলো দেশে বাঁচার উপায় নাই” ও “মুজিব বাইয়া যাওরে তোমার ৬ দফারি নাও নিপীড়িত দেশের মধ্যে জনগনের নাও মুজিব বাইয়া যাওরে” ইত্যাদি গান আমাদেরকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে মারাত্মকভাবে উৎসাহিত করতো। তিনি বলেন,আমি মান্যবর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করে বাউল কামাল পাশাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদানের দাবী জানিয়েছি।
এদিকে বাউল কামাল পাশাকে মরণোত্তর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রীর প্রতি উদাত্ত আহবাণ জানিয়েছেন বাউল কামাল পাশা সংস্কৃতি সংসদ নামের সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক সাংবাদিক বাউল আল-হেলাল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের জনপ্রতিনিধি ও উর্ধতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
বাউল কামাল পাশার (কামাল উদ্দিন) ১২২ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ৬ ডিসেম্বর বুধবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমীর উদ্যোগে এক আলোচনা সভা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত দেশাত্ববোধকসহ জনপ্রিয় গান নিয়ে বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানটি উপভোগ করার জন্য সকল সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবাণ জানিয়েছেন জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কালচারাল অফিসার আহমেদ মঞ্জুরুল হক চৌধুরী পাভেল।