নিজস্ব প্রতিবেদক :: নানান অনিয়ম ও অসঙ্গতিতে ভরা সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অব্যবস্থাপনা ও দায়সারা ভাবে চলছে উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ১৫৫ টি গ্রামের প্রায় ২ লক্ষাধিক জনসংখ্যার চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল এই হাসপাতাল। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এই জনসংখ্যার চিকিৎসায় বিশ্বাসভঙ্গ করছেন উপজেলা হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসান যোগদানের পর থেকে ডাক্তার, মেডিকেল এ্যাসিসটেন্টরা যার যার মতো অফিস করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিনের বেলা ডাক্তারা হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিলেও বিশেষ করে রাতের বেলায় ডাক্তারের পরিবর্তে চিকিৎসা দিচ্ছেন ডিপ্লোমা মেডিকেল এ্যাসিসটেন্টরা। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসান নিয়মিত তদারকী না করায় দিন দিন হাসাপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছেন। বিশেষ করে দিনে-রাতে জরুরী বিভাগে গুরুতর কোন রোগী আসলে ডাক্তার ও ডিপ্লোমা মেডিকেল এ্যাসিসটেন্টরা পূর্ণাঙ্গ সেবা না দিয়ে দায় সাড়া ভাবে সেবা দিয়ে দ্রুত সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতাল না হয় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করছেন। ফলে প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসান মাসের অধিকাংশ সময়ে নিজ অফিসে অবস্থান না করে খাতা-কলমে ঠিক রেখে নিজ জেলা মৌলভীবাজার ও সিলেট শহরে অবস্থান করেন। কেউ খোঁজতে গেলে দেখা যায়, উনার অফিসের দরজা খোলা, ফ্যান ও এসি চলছে। কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন স্যার বাহিরে আছেন, মাঠে আছেন। এভাবেই দিনকে দিন দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ রয়েছে ডা. ইকবাল হাসানের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলার পশ্চিম বীরগাঁও ও জয়কলস ইউনিয়নে থেকে আগত দুই বৃদ্ধ মহিলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসেন। তাদের আর্থিক অবস্থা ভাল না হওয়ায় অসহায় ও নিঃস্ব হতদরিদ্র রোগীদেরকে উপজেলা সমাজ সেবার অধীনে রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে আর্থিক সহায়তা ও ঔষধ বিনামূল্যে প্রদানের জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসানকে সুপারিশ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রোগী কল্যাণ সমিতির ফান্ডে টাকা নাই এবং নানা অজুহাতে রোগীদেরকে ফিরিয়ে দেন বলে রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার একঘেয়েমির কারণে উপজেলা সমাজ সেবা অফিসের সরকারি রোগী কল্যাণ ফান্ডের অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ উপজেলার হতদরিদ্র রোগীরা।
আরো জানা যায়, বিগত ৫/৬ মাস আগে শান্তিগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে রোগীদের বিশুদ্ধ পানির নলকূপ অকেজো হওয়ায় দীর্ঘদিন হাসপাতালে পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। পরে গণমাধ্যম কর্মীদের সংবাদ প্রকাশের পর উপজেলা সমাজ সেবার রোগী কল্যাণ সমিতির অর্থায়নে পানির ফিল্টার হাসপাতালে স্থাপন করা হয়। অন্যদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাসপাতালের পুকুরের মাছ বিক্রি করে, হাসপাতালের অন্যান্য ফান্ড থেকে এসকল সমস্যাগুলো বাস্তবায়ন না করে হাসপাতালের প্রতি অবহেলা ও অদুর্শিতার কারণে দিনকে দিন হাসপাতালটি অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত হচ্ছে। দিবা রাত্রি দায়িত্ব পালন করছেন না অধিকাংশ ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেবা গ্রহিতা রোগীর মেয়ে জানান, আমার মায়ের বয়স ৭০ বছর। আমার মাকে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে অনেক টাকার ঔষধ লাগবে বলে ডাক্তার জানান। তখন হাসপাতালের বড় স্যারের কাছে রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে ঔষধ দেয়ার কথা বলি। তখন বড় ডাক্তার স্যার আমাদের কোন সহযোগিতা করেননি। রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে কোন ঔষধ দেওয়া যাবে না, কোন ফান্ড নাই বলে তিনি জানান। পরে আমার অসুস্থ মাকে বাঁচাতে উপজেলা সমাজ সেবা ম্যাডামের কাছে নিয়ে যাই। তিনি আমার মাকে দেখে ২ হাজার টাকার ঔষধ ফার্মেসীর মাধ্যমে দেন। আমার কোন ভাই নাই। আমরা দুই বোন আর মা আমাদের পরিবারে আছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ষাটোর্ধ এক মহিলা জানান, আমি হাসপাতালে গেলে আমাকে তারা ভর্তি হতে বলেন। আমি তাদের কথা মতো হাসপাতালে ভর্তি হতে গেলে ডা. ইকবাল স্যার বলেন, আমরা যে ফার্মেসীর অধিনে ঔষধ দেই। এমাস থেকে তাকে বাঁধ দেয়া হবে। ১০/১২ দিন পরে হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে আমরা ঔষধের ব্যবস্থা করে দেব। পরে আর দেন নাই।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোছা. তাছলিমা আক্তার লিমা বলেন, রোগী কল্যাণ সমিতিতে পর্যাপ্ত পরিমান টাকা রয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে সুপারিশ ক্রমে আমরা রোগীকে যাতায়াত ভাড়া, ঔষধের মূল্য সহ নানা আনুষাঙ্গিক কারণে সহায়তা দিয়ে থাকি। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইকবাল হাসান অভিযোগের বিষয়ে বলেন, উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায় এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রোগী কল্যাণ ফান্ডের অর্থায়নে যে ফার্মেসীর অধীনে ওষধ বিতরণ করা হতো। সেই ফার্মেসীর সাথে আমাদের কন্ট্রাক্ট বন্ধ রয়েছে। ১/২ সপ্তাহের মধ্যে নতুন ফার্মেসীকে দায়িত্ব দিলে পুনরায় বিতরণ করা হবে। রাতে ডাক্তারা ডিউটি না করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি জানান, যারা ডিউটি করেন না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন শরীফি বলেন, সমাজ সেবা অধীনে রোগীদের জন্য যে ভাতা চালু আছে। সেগুলো পাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। নিয়মের ভিতরে থাকলে সেটা না দেওয়ার কোন কারণ নেই। যে দুজন রোগী অভিযোগের কথা বলেছেন তারা যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেন। তাহলে বিষয়টি খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা নেব। এছাড়া চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালনে অবহেলা বা অনিয়ম করে থাকলে খোঁজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসকরা ডিউটি পালন না করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।










