কাজী জমিরুল ইসলাম মমতাজ :: সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের কাবিলাখাই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আকল মিয়ার খড়ের ঘরে আগুন লাগার ঘটনায় প্রতিপক্ষ গ্রামের নুরুল হকের পরিবারকে ফাঁসানোর চেষ্টায় থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন বলে জানিয়েছেন মামলার প্রধান স্বাক্ষী। এ ঘটনায় এলাকায় উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে গ্রামবাসী বলছেন, আগুন লাগার ঘটনা সত্য, তবে কে বা কারা সেই আগুন দিয়েছে কেউ অবগত নয়। আমরা গ্রামবাসী অনেক চেষ্টা করেছি যাতে কেউ কাউকে গায়েল না করে মামলা মকদ্দমায় না জড়ান। কিন্তু আখল মিয়া গ্রামের কারও কথা না শুনে সম্পূর্ণ মিথ্যা একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। আখল মিয়ার মামলার প্রধান স্বাক্ষীকে প্রাণে হত্যার ভয় দেখিয়ে মিথ্যা স্বাক্ষ দিয়েছেন বলে জানান, মামলার অভিযোগ পত্রের প্রধান স্বাক্ষী আবু মিয়া।
জানা যায়, গত শনিবার (১০ মে) রাত সাড়ে ৮টায় কাবিলাখাই গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়ার খড়ের ঘরে আগুন লাগলে গ্রামবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের চেষ্ঠায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। খড়ের ঘরটিতে গ্রামের আবু মিয়া, সুজাত মিয়া, রুহুল আমিন ও আব্দুর রাজ্জাক আখল মিয়ার খড়র রক্ষিত ছিল। আগুনটি লেগেছিল আবু মিয়ার রক্ষিত খড়ে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন গ্রামবাসী ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন। এ ঘটনায় গত (১১ মে) রবিবার আব্দুর রাজ্জাক আখল মিয়া বাদী হয়ে গ্রামের প্রতিপক্ষ মৃত হাজী উলফত উল্লাহ’র ছেলে নুরুল হক, নুরুল হকের ছেলে রাজিব মিয়া ও তাদের গৃহকর্মী সাগর মিয়াকে আসামী করে শান্তিগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগ পত্রে মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে আবু মিয়াকে রাখা হয় প্রধান স্বাক্ষী।
অপরদিকে গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারী) রাতে প্রতিপক্ষ মৃত হাজী উলফত উল্লাহ’র ছেলে নুরুল হক’র গরুর ঘর থেকে তালা কেটে ৪টি গরু চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। ঘটনার পরদিনই নুরুল হক শান্তিগঞ্জ থানায় তার গরু চুরির ঘটনায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ঐ সময় চুরি যাওয়া গরু গুলোর কোন সন্ধান পাননি তিনি। কিছুদিন আগে গ্রামের কয়েক জনের মাধ্যমে জানতে পারেন গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়া, মৃত লিয়াকত মিয়ার ছেলে মো. সুজাত মিয়া ও সুজাত মিয়ার ছেলে রিপন মিয়া গরু চুরির রাতে নুরুল হকের বাড়ির রাস্তায় ঘুরাফেরা করেন। এ ঘটনায় গ্রামবাসীর কাছে নুরুল হক বিচারপ্রার্থী হলে গত (০৫ মে) রাতে গ্রামের (সাবেক মেম্বার) নুর মিয়ার বাড়িতে বিচার সালিশ বৈঠক হয়। বিচার অমান্য করে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়াসহ তার পক্ষের লোকজন নুর মিয়াকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে বৈঠক থেকে চলে যান। এসময় পরিস্থিতি উত্তেজনা দেখা দিলে গ্রাম্য সালিশ ব্যক্তিরা নুরুল হকের লোকজনকে শান্ত থাকতে অনুরোধ করেন। পরে গ্রাম্য সালিশ ব্যক্তিরা ঘটনাটি নিয়ে আবার বসার আশ্বাস দেন। গ্রাম্য সালিশ অমান্য না করার জন্য অনুরোধ করে নুরুল হকের লোকজনকে থানায় মামলা না করার জন্য বলেন। এ ঘটনা উল্লেখ করে গত রবিবার (১৮ মে) নুরুল হক বাদী হয়ে তার গরু চুরির ঘটনায় ও প্রাণে হত্যার হুমকির ঘটনা উল্লেখ করে গ্রামের মৃত আব্দুল মন্নানের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়া, মৃত লিয়াকত মিয়ার ছেলে মো. সুজাত মিয়া ও সুজাত মিয়ার ছেলে রিপন মিয়াকে আসামী করে শান্তিগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
খড়ের ঘরে আগুন লাগার ঘটনায় আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়ার মামলার প্রধান স্বাক্ষী মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে আবু মিয়া জানান, আমি অসহায় মানুষ। জায়গা জমি আমার নাই। প্রতি বছরের মতো এই বছরও আমার গরুর জন্য কিছু খড় শুকিয়ে আখল মিয়ার খড়ের ঘরে রেখেছিলাম। কিন্তু গত কয়দিন আগে আমার রাখা খড়ের মধ্যে কে বা কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আমরা আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে আসি আগুন নেবানোর জন্য। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিবাতে সক্ষম হন। এ সময় আখল মিয়া সহ সবাই আমরা গ্রামবাসীকে জানিয়েছে কে আগুন লাগিয়ে আমরা দেখিনি। পরের দিন সকালে আখল মিয়া ও উনার ভাই আব্দুল ছোবহান সহ তাদের লোকজন আমাকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে বলে, তর কারণে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। সব ক্ষতিপুরণ তুই দিবে। না হলে আমরা যে ভাবে বলবো সে ভাবে চলতে হবে। তারা আমাকে বলেছে, নুরুল হক চাচার বিরুদ্ধে তারা মামলা করবে, ফেসবুকে লাইভ দিবে, আমি যেন নুরুল হক চাচা ও উনার ছেলে রাজিবের বিরুদ্ধে কথা বলি। পরে আমার জান বাচাতে তাদের কথা মতো আমি তাদের মামলায় স্বাক্ষী হিসেবে নাম লেখাই ও ফেসবুকে লাইভে কথা বলি। আমি যা বলেছি তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও তাদের সেখানো কথা।
প্রতিপক্ষ নুরুল হক জানান, আমার ৪টি গরু দুই আড়াই মাস আগে আমর গুরু ঘর থেকে চুরি হয়েছে। সে সময় অজ্ঞাতনামা আসামি দিয়ে থানায় অভিযোগ দিয়েছি। গত কয়েকদিন মাস খানেক আগে আমি জানতে পারি গরু গুলো আখল মিয়া ও তার লোকজন চুরি করেছে। এ নিয়ে গ্রামে সালিশ বৈঠক হয়েছে। গ্রাম্য সালিশ অমান্য করে আখল মিয়া আমাকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে বৈঠক থেকে চলে যায়। পরে গ্রামের লোকজন আমাদের বিষয়টি দেখে দিবেন বলে আশ্বস্ত করেন। গরু চুরির ঘটনাকে ধামাচাপা দিতেই তারা তাদের খড়ের ঘরে আগুন দিয়ে আমাদের বিরোদ্ধে থানায় অভিযোগ দিয়েছে। যা সম্পূর্ণ একটি নাটক। তার অভিযোগের প্রধান স্বাক্ষী আবু মিয়াকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে নাটক সাজিয়েছে।
আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আখল মিয়া জানান, আমার খড়ের ঘরে আমি সহ আবু মিয়া, সুজাত মিয়া ও রুহুল আমিনে খড় রক্ষিত ছিল। নুর মিয়ার ছেলে রাজিব কিছুদিন আগে আমাকে হুমকি দিয়ে বলেছিল আমার খড়ের ঘর পুড়িয়ে দিবে। গত (১০ মে) রাত সাড়ে ৮টার সময় আমার ঘরে তারাই আগুন লাগিয়েছে। গ্রামের সবাই ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আবু মিয়ার খড়েই প্রথমে আগুন লেগেছে। ফেসবুক লাইভে সে সময় স্বীকার করেছে যে, নুরুল হক ও রাজিব মিয়া তার খড়ে আগুন লাগিয়েছে। আমরা তাকে কেন ভয় দেখাবো। এখনতো মনে হচ্ছে যে, আবু মিয়াকে নুরুল হক ও তার ছেলে ভয় ভীতি দেখিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলাচ্ছে। গরু চুরির ঘটনায় তাদের কোন সম্প্রীক্ততা নাই। আমরা নিরিহ মানুষ, গ্রামের বিচার সালিশকারী সবাই নুরুল হকের মানুষ।
গ্রামের সালিশ ব্যক্তি গয়াছ মিয়া জানান, গরু চুরির ঘটনায় আমরা গ্রামবাসী মিলে সালিশ বৈঠকে বসেছিলাম। আখল মিয়ার লোজকন সালিশ অমান্য করে বৈঠক থেকে চলে যায়। পরে নুরুল হকের লোকজনকে আমরা শান্ত থাকতে বলি। বিষয়টি আমরা আবার উভয় পক্ষকে নিয় গ্রাম্য শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে বসার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আখল মিয়ার লোকজন আমাদেরকে পাত্তাই দেননি। কয়েকদিন আগে আখল মিয়ার খড়ের ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর পরেও আমরা আখল মিয়ার লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেছি। উভয় পক্ষের দ্বন্ধ নিরসন করার জন্য। আখল মিয়া আমাদের কথা না শুনে তিনি নুরুল হক ও তাঁর ছেলে রাজিবকে আসামী করে মামলা করেছেন। এখন আবার সেই মামলার স্বাক্ষী আমাদের কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে বলছেন, আখল মিয়ার লোকজন তাকে প্রাণে হত্যার হুমকি দিয়ে মিথ্যা স্বাক্ষ্য ও ফেসবুকে লাইভ করিয়েছেন।
সাবেক ইউপি সদস্য ও গ্রাম্য সালিশ ব্যক্তি নুর মিয়া জানান, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি উভয় পক্ষের সমস্যা সমাধান করার। কিন্তু আখল মিয়া গ্রাম্য সালিশ অমান্য করেছে। এখন উভয় পক্ষই মামলা মকদ্দমায় চলে গেছেন। আমরা গ্রামের শান্তিশৃংখলা বজায় রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আখল মিয়ার লোকজন সেটাকে গোলাটে পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন। নুরুল হক সাহেবের গরু চুরি হয়ছে দুই আড়াই মাস আগে। গত মাস খানেক আগে নুরুল হক সাহেব আমাদের কাছে বিচার প্রার্থী হয়ে বলেছেন আখল মিয়া তাঁর গরু গুলো চুরি করেছেন। আমরা বিচারের মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আখল মিয়ার লোকজন সেটা মানেন নি। পরে ঘর জালানোর ঘটনা ঘটলেও আমার চেষ্টা করেছি উভয় পক্ষকে নিয়ে বসার। সেটাও সম্ভব হয়নি আখল মিয়ার লোকজনের কারণে।
শান্তিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম আলী জানান, খড়ের ঘর পুড়ানো ও গরু চুরির বিষয়ে দরগাপাশা ইউনিয়নের কাবিলাখাাই গ্রামের উভয় পক্ষের দুটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুটি বিষয় গুরুত্বের সাথে আমরা দেখছি।