আজ, , ২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সংবাদ শিরোনাম :
«» বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা «» প্রেসক্লাবে শিক্ষানুরাগী আব্দুল হান্নানকে সংবর্ধনা «» খালেদা জিয়ার সাথে ৩ ছাত্র উপদেষ্টার কুশল বিনিময় «» ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার «» মাদ্রাসা অঙ্গনে পিএইচডি ও এমফিল ডিগ্রিধারী ২৫০ জন শিক্ষকের সংবর্ধনা «» জগন্নাথপুরে পরীক্ষায় ফেল করায় দশম শ্রেণির ছাত্রীর আত্মহত্যা «» জগন্নাথপুরে চুরির মামলার পলাতক আসামি গ্রেফতার «» জগন্নাথপুরে এমএ মান্নানসহ আ.লীগের ৪৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা «» নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার নাসির উদ্দীন «» ব্যারিস্টার সুমনের দুই দিনের রিমান্ডে, আদালতে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ





১৬ ডিসেম্বর : হে বিজয় তোমাকে খুজি- ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। বাঙ্গালী জাতির কাছে এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অন্য মাসগুলোর চেয়েও অনেক বেশি। দেশে বিদেশে যেখানেই বাঙ্গালীরা রয়েছেন সেখানেই এ মাসের ১৬ তারিখে যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপন করা হয়। এ দিবসকে আমরা কেউ ভুলতে দেই না। কারণ এ দিবসের পেছনে রয়েছে জীবন্ত একটি ইতিহাস। এ ইতিহাস আমাদের প্রেরণা দেয়। উজ্জীবিত করে।
দীর্ঘ ন’টি মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে এ মহান দিবসেই আত্মসমর্পণ করেছিলো। আমরা সেই ঐতিহাসিক দিনেই পৃথিবীর মানুষের কাছে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলাম। লাল সবুজের দেশ বাংলাদেশ দুনিয়ার মানচিত্রেও আপন জায়গাটুকু করে নিয়েছিলো। আজ আমরা সেই লাল সবুজের দেশেরই নাগরিক। জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীন। আজ আমাদের একটি পতাকা আছে। একটি মনোগ্রাম আছে। একটি মানচিত্র আছে। বিশ্বের মানচিত্রে আমরা সগৌরবে বিদ্যমান।

অসংখ্য জীবন, অঢেল রক্ত এবং আরো বহুবিধ ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিজয়। আর ইহা একক কোনো দল বা কোন গোষ্ঠীর দ্বারা অর্জন হয়নি। সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ত্যাগ ও লড়াইয়ের পটভূমিতেই দেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের সূর্যের উদয় ঘটেছিল তা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। আজ স্বাধীনতা ও বিজয়ের চার দশক পেরিয়ে গেছে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রয়োজন আজ একটু হিসাব নিকাশের। প্রয়োজন আত্ম জিজ্ঞাসার। আমরা কি কারণে যুদ্ধ করেছিলাম পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে? দীর্ঘ চার দশকে কি পেয়েছি? স্বাধীনতার প্রাপ্তিটুকু কি পুর্নাঙ্গভাবে অর্জন করতে পেরেছি? বিজয়ের প্রকৃত স্বাধ সব শ্রেণী, সব পেশার মানুষ কি ভোগ করতে পেরেছে? শুধুমাত্র একটি মনোগ্রাম আর লাল সবুজের পতাকার জন্য দেশের মানুষগুলো কি রক্ত দিয়েছিল? প্রাণ দিয়েছিলো?

বছরে একবার ১৬ই ডিসেম্বর ও ২৬শে মার্চকে আলিঙ্গন করি। এ আলিঙ্গনে বিজয়কে খুজি। স্বাধীনতাকে খুজি। মুক্তিকে খুজি। কিন্তু বিজয় মুক্তি ও স্বাধীনতাকে সংখ্যালঘুদের ঠিকানায় দেখতে পাই। অবস্থা বুঝে মনে হয় বিজয় তাদের জন্যই হয়েছিলো। স্বাধীনতা এসেছিল তাদের কপাল খুলে দেয়ার জন্য। শুধুমাত্র এই সংখ্যালঘুদের কপাল খুলে দেয়ার জন্য তো ১৯৭১ সালে দেশের মানুষ অস্ত্রহাতে পাকিস্তানি শত্রুবাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেনি। যুদ্ধটা মূলত ছিল শোষকের সঙ্গে শোষিতের্। অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের্। জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের্। এ যুদ্ধ কেবল পাঞ্জাবি বিতাড়নের জন্য তো ছিলনা। এ যুদ্ধ ছিল শোষণহীন ইনসাফপূর্ণ একটি সত্য ও সুন্দর সমাজ গড়ার। জুলুম থেকে মানবতার মুক্তির।

কিন্তু মানবতার মুক্তি কই? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কই? মিডিয়ার স্বাধীনতা কই? মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কই? একজন লেখকের লেখার স্বাধীনতা কই? অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করার অধিকার কই? প্রতিদিন নারীরা নির্যাতন, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, নারীদের ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা কই? দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। গুম হচ্ছে। ধর্ষিত হচ্ছে। অপহরণ হচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় বি এস এফ কর্তৃক আমার দেশের মানুষ প্রায়ই হত্যার শিকার হচ্ছে। ঘর থেকে নিরাপরাধ মানুষদের মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধীরা বিনা সাজায় জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে। আইন,আদালত, প্রশাসন সহ সবকিছু দলীয়করন করা হচ্ছে। এসব কি ছিলো বিজয়ের অঙ্গিকার? এসব পাওয়ার জন্য কি দেশকে স্বাধীন করা হয়েছিলো?

আমরা এমন এক জাতি স্বাধীনতার চার দশক পরেও স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধাদের সঠিক একটি তালিকা প্রনয়ণ করতে পারিনি। প্রতিহিংসার রাজনীতির খপ্পরে পড়ে কখনো মুক্তিযুদ্ধাকে রাজাকার আর রাজাকারকে মুক্তিযুদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে প্রশ্নবৃদ্ধ করে তুলেছি স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসকে।

ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে বারবার কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শাসনের নামে জনগনকে শোষণ করা হয়েছে এবং বর্তমানেও হচ্ছে। জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও রাতারাতি ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদদের। আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন একে একে অনেকেই। যার একতলা বিল্ডিং ছিল তার হয়েছে পাচতলা। আর যার পাচতলা ছিল তার হয়েছে দশতলা। তারা পরিবার নিয়ে থাকছেন রাজধানীর গুলশানে। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার জন্য দেশে নয়, বিদেশে করেছেন ঠিকানা। অনেকেই কিনেছেন বিদেশে আলীশান বাড়ী। আজ তারাই দেশের প্রথম শ্রেনীর নাগরিক। দেশের সেরা মানুষের তালিকায় তাদের নাম। তাদের জন্য রয়েছে রাষ্ট্রের সব সুযোগ সুবিদা। তাদের জীবনে কোন সমস্যা, কোন বাধা, কোন কষ্ট আছে বলে মনে হয় না। রাজকীয় জীবনযাপন যেন তাদের। ক্ষমতাবান বলেই আইন, আদালত সবই তাদের ইশারায় চলে। যারা তাদের সুনজরে পড়েছেন তারাই চাকরী পান, টেন্ডার পান, ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, গ্রামের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। যেন মনে হয় কপালপোড়া জাতি। হাজারও স্বপ্ন নিয়ে যুগ যুগ পার করছে কিন্তু ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি তাদের। দারিদ্র এই মানুষগুলোর সময়ের ডায়েরি থেকে বছরের পর বছর কেটে যায় মাটির ঘরে ইট লাগাতে পারেনা। পয়সা খরছ করতে পারেনা বলেই সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারে না। গ্রামের স্কুল পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়ে যায় তাদের সন্তানদের ছাত্রজীবন। যৌতুক দিতে পারেনা বিধায় যুবতী মেয়ের বিয়ের ব্যবস্তা করতে পারে না। ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু হাউজিং সমস্যার কারণে ছেলেকে বিয়ে করাতে পারে না। কেউ এমনও আছেন যে কোন মতে ছেলে মেয়েকে শিক্ষিত করে তুলেছেন কিন্তু ঘুষের টাকা রেডি করতে ব্যর্থ হওয়ায় চাকুরী হচ্ছে না। এরকম গ্রামে-গঞ্জে লাখ লাখ মানুষ রয়েছেন যারা নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর জন্য দিনরাত চেষ্টা করছেন, সুন্দর ও সফল একটি জীবনের জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন কিন্তু জীবনের স্বাধ ও স্বপ্ন সবই কল্পনার ডায়রিতে রয়ে যাচ্ছে বাস্তব জীবনে আলোর মুখ দেখছে না।

আমাদের সমাজে বিশাল আরো একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে খুবই অবহেলিত। তাদের ভিটেমাটি পর্যন্ত নেই। ট্রেন স্টেশন আর ফুটপাতে তাদের বসবাসের ঠিকানা। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার অভাবে সমাজে তাদের অবস্থান সর্বনিম্নে। তাদের করুণ এ অসহায়ত্ব রাষ্ট্রের অভিভাবকদের চোখে পড়ে না। তাদের আহাজারী রাজনীতিবীদদের কানে পৌছে না। ঐসকল অসহায় বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে রাষ্ট্রের অভিভাবকদের উপর কি কোন দায়ীত্ব নেই? দেশ তো স্বাধীন করা হয়নি একশ্রেণীর মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। এদেশ স্বাধীন করা হয়েছিল সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। মুক্তির জন্য। বিজয়ের জন্য। কিন্তু আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তি নেই। বিজয় নেই।

বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস আসলেই রাজনীতিবীদদের দেশপ্রেম, জাতিপ্রেম বেড়ে যেতে দেখা যায়। রাতের আধারে শহীদ মিনারে ফুল আর লাল সবুজের পতাকা নিয়ে রাজপথে তাদের দৌড়ঝাপ চোখে পড়ে। বক্তব্য আর বিবৃতির মধ্যে স্বাধীনতা আর বিজয়ের সুন্দর সুন্দর গান ফুঠে উঠে। কিন্তু যখন দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন মানুষ খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণের সংবাদ কানে আসে, সীমান্তে ভারতীয় বি এস এফ কর্তৃক ফেলানী হত্যার সংবাদ শুনি, নিরাপরাধ মানুষের কারাগারে বন্দীর সংবাদ শুনতে পাই, অপরাধীরা বিনা সাজায় জেল থেকে মুক্তির সংবাদ শুনি, ফাসির আসামী রাজনৈতিক সুপারিশে খালাস পাওয়ার খবর শুনতে পাই তখন তাদের দেশপ্রেম দেখানোকে প্রতারণা ও ভাওতাবাজী বলে মনে হয়। ধিক্কার জানাতে হয় তাদের তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মসূচীকে।

তথাকথিত এসব রাজনীতিবিদরা সমাজে এককভাবে রাজনীতির ঠিকাদার হয়ে থাকতে চায়। সুশীলদের যেমন রাজনীতিতে দেখতে নারাজ, তেমনি ইসলামী রাজনীতিকে গতিশীল ও উদীয়মান শক্তি হিসাবে ছেড়ে দিতেও রাজী নয়। তাদের মধ্যে একধরনের ভয় মারাত্মক কাজ করে যে, ইসলামী রাজনীতি তাদের ওপর চেপে বসে কি না। তারা ভালো করে জানে যে, ইসলামী রাজনীতিবীদরা সমাজের নেতৃত্বে চলে আসলে তাদের অনেক পথ বন্ধ হয়ে যাবে। শাসনের নামে জনগনকে আর শোষণ করতে পারবে না। দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাত করতে পারবে না। পাহাড় পরিমান সম্পদের মালিক হতে পারবে না। আইন আদালতকে তাদের হুকুমে চালাতে পারবে না। এজন্য তারা মিথ্যাচার, বিদ্রুপাত্মক সমালোচোনা, সন্দেহ সৃষ্টি, মানুষের পথ রোধ করা ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতির পথকে বাধাগ্রস্ত করতে ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে আছে প্রতিনিয়ত।

বাঙালি জাতি আজ আর বোকা নয়। চার দশক তাদের শাসন দেখেছে। সেই পাকিস্তানিদের মতো তারাও জনগনকে শাসনের নামে শোষণ করছে রীতিমতো। স্বাধীনতার কোনো সুফল ভোগ করতে পারেনি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জিত হলেও তা কাগজে, কলমে, বক্তৃতায় আর বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ রয়েছে। একটি সুস্থ রাজনীতির সুফল ভোগ করার জন্য জাতি আজ উদগ্রীব হয়ে আছে। শোষিত, বঞ্চিত মানবতা আজ মুক্তি চায়। পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা চায়। প্রকৃত বিজয় চায়।

এখানে ক্লিক করে শেয়ার করুণ